মুহম্মদ আজিজুল হক.
১৫ই জুলাই ১৯৬৭ –আমার জীবনের একটি রেড-লেটার ডেই। ক্যাডেট কলেজে প্রবেশের জন্য নির্ধারিত লিখিত, মৌখিক, ও মেডিক্যাল টেস্টে উত্তীর্ণ হয়ে আমরা ৫৩ জন কৈশোরোন্মুখ বালক ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ফোর্থ ইনটেকের/ব্য্যাচের ছাত্র হিসেবে ঐ দিন উক্ত কলেজের স্নিগ্ধ ও সুশোভিত ক্যাম্পাসে পা রাখি। পুরো ক্যাম্পাসটি আমাদের চোখে মুগ্ধতার আবেশ ছড়ায়। কলেজের প্লে-গ্রাউন্ডস এবং প্রতিটি লন যেন হরিতাশ্মের মতন সবুজ ঘাসের গালিচা-আবৃত। তার মাঝে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে সাদা রংয়ের কলেজ ব্লক, তিনটি হাউজ (ছাত্রাবাস) এবং অন্যান্য বিল্ডিংসমূহ –যেন ঘন সবুজ গালিচার ওপর উপবিষ্ট কতিপয় বিশালকায় শ্বেত-শুভ্র কপোত, কপোতী। কলেজের মূল গেইট থেকে শুরু কোরে প্রিন্সিপাল মহোদয়ের অফিস ও একাডেমিক বিল্ডিং পেরিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে পরিপাটি কোরে ছাঁটা হেজ ঝোপের বৃতি; এবং কিছু দূর পর পর মাঝারি সাইজের এক একটি কৃষ্ণচূড়া। আমাদের সকলের সঙ্গেই ছিল আমাদের পিতামাতা বা অন্য কোনো অভিভাবক। সবার মুখ ছিল সাফল্যের গৌরবে হাস্যোজ্জ্বল, চোখে ছিল আগামীর রঙ্গিন স্বপ্ন। তথাপি, নতুন পরিমন্ডলে নতুনদের মাঝে এসে যেন কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ। ক্যাডেট কলেজ সম্বন্ধে এখন দেশবাসীর সকলেই কমবেশি অবগত। তাই বলা বাহুল্য, সকল ক্যাডেট কলেজের শ্রেণি-বিস্তৃতিতে সপ্তম শ্রেণি হছে শুরুর শ্রেণি এবং দ্বাদশ শ্রেণি হচ্ছে শেষ শ্রেণি। যদ্দূর মনে পড়ে, আমাদের ৫৩ জনের সকলেই বেলা বারোটা একটার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল কলেজে। আমাদের প্রত্যেককে দেখভাল করার জন্য এবং কলেজের প্রাত্যহিকতার এবং রুটিনের সাথে যাতে তাল মিলাতে পারি এবং তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি সেই উদ্দেশ্যে আমাদের ঠিক ওপরের ক্লাসের, অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণির এক একজনকে আমাদের এক একজনের দায়িত্ব দেয়া হলো। আমাকে দেয়া হলো বশীরুল আলম চৌধুরী বা বশীর ভাইয়ের দায়িত্বে। বশীর ভাই আপন বড় ভাইয়ের মতো তাঁর হৃদয়ের স্নেহমাখা স্পর্শে আমাকে ক্যাডেট কলেজের কঠোর ছকে বাঁধা সুশৃঙ্খল জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হতে ও মানিয়ে নিতে সাহায্য কোরেছিলেন কিছুদিন যাবৎ। উল্লেখ্য, আমার ক্যাডেট কলেজ জীবন ছিল জুলাই ১৯৬৭ থেকে এপ্রিল ১৯৭৪ পর্যন্ত। আমাদের ইনটেকের ক্যাডেট নম্বর ছিল ১৭০ থেকে ২২২ পর্যন্ত। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ক্যাডেট নম্বর দেয়া হয়। আমার ক্যাডেট নম্বর ছিল ১৭৪; অর্থাৎ আমি ছিলাম পঞ্চম স্থানে।
ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন Colonel Smitherman নামক একজন ইংরেজ। আরো কয়েকজন শিক্ষকও ছিলেন ইউনাইটেড কিংডম, অর্থাৎ যুক্তরাজ্য থেকে। নাম ছিল Mr. Crabtree, Mr. Melville, এবং Mr. Jackson । Mr. Melville ছিলেন স্কটিশ। তাঁরা হয়তো Commonwealth Exchange Programme-এর আওতায় কয়েক বছরের জন্য ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে চাকরি কোরতে এসেছিলেন। Col. Smitherman বেশ বয়সী ছিলেন। ব্যাঙের মতন দেখতে তাঁর Volkswagen Beetle গাড়ীটি তিনি নিজে চালাতেন কলেজ ক্যাম্পাসে। ছাত্রদের প্রতি তাঁর আচরণ ছিল খুব স্নেহশীল। তাঁর স্নেহশীলতা এবং প্রবীণতার কারণে ক্যাডেটরা তাঁর নিকনেইম দিয়েছিল ‘নানা’(grandpa)। Col. Smitherman তা জানতে পেরে ভীষণ স্নেহশীল ছিলেন ছাত্রদের প্রতি। বোধকরি ছাত্রদেরকে দেখে সুদূর বৃটেনে ফেলে আসা তাঁর নিজ নাতি-নাতনিদের কথা তাঁর মনে আসতো। তবে তাঁকে আমরা, অর্থাৎ চতুর্থ ইনটেকের ছাত্ররা, বেশিদিন পাই নি। কলেজে আমাদের ভর্তির এক বছরের মধ্যে তিনি কলেজে তাঁর চাকরি শেষ কোরে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর বিদায়কালে ছাত্রদের অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদেছিল। অধ্যক্ষ Col. Smitherman-এর স্থলে লে. কর্নেল মঞ্জুরুর রহমান এলেন নতুন অধ্যক্ষ হয়ে।
যাহোক, কলেজে আমাদের ইনটেকের প্রথম দিনের কথায় ফিরে আসা যাক। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে তিনটি হাউস ছিল এবং আমার জানামতে এখনো সেই সংখ্যক হাউসই আছে –বদর হাউস, খায়বর হাউস এবং হুনাইন হাউস। (ইয়ারমুক হাউস নামকরণে আরো একটি হাউস নির্মিত হবার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়েছে বোলে শুনি নি।) নবাগত ৪র্থ ইনটেকের ছাত্রদের এবং তাদের পিতামাতাদের সাথে প্রত্যেক হাউসের হাউস মাষ্টার এবং হাউস টিউটর পরিচিত হলেন। হাউস মাষ্টার মূলত একজন শিক্ষক, যিনি একটি হাউসের সার্বিক পরিচালনার দায়িত্বে থকেন। হাউস টিউটরও একজন শিক্ষক যিনি একটি হাউসের ছাত্রদের সাথে একই হাউসে বাস করেন এবং ঐ হাউসের ছাত্রদের দেখভাল করেন এবং হাউসের ছাত্রগণ যাতে সব নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে পালন করে এবং সপ্তাহের বিভিন্ন দিনের কার্যক্রমে পাঙ্কচুয়ালি এবং যথাযথভাবে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেয় তা নিশ্চিত করেন। তাঁর জন্য হাউসের তিন তলায় নির্মিত একটি ফ্লাটে সপরিবার বসবাসের ব্যবস্থা ছিল; যা নিশ্চয়ই এখনো আছে। কলেজ/একাডেমিক ব্লকে সকলে হালকা রিফ্রেশমেন্টসে আপ্যায়িত হলেন। নিয়মানুযায়ী, নবাগত কোনো ইনটেকের ছাত্রদের কাকে কোন হাউসে এবং হাউসের কোন ডোরমিটরিতে প্লেস করা হবে তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। সেই অনুযায়ী আমাকে এবং আমাদের ইনটেকের সবাইকে আমাদের এক ক্লাস ওপরের তত্ত্বাবধায়ক সিনিয়র ভাইয়েরা নিয়ে গেলেন আমাদের নিজ নিজ হাউসে এবং ডোর্মে। সাথে গেলেন আমাদের প্যারেন্টসগণ, যাতে তাঁরা অবগত হতে পারেন তাঁদের নিজ নিজ সন্তানটি ঠিক কোন্ হাউসের কোন্ ডোরমিটরিতে থাকতে যাচ্ছে। আমাকে প্লেস করা হয়েছিল বদর হাউসে। (তখন ঐ হাউসের হাউস মাষ্টার ছিলেন উর্দুভাষী মিষ্টার নাইয়ারে আযম। হাউস টিউটর ছিলেন ইতিহাসের শিক্ষক মিষ্টার আবদুল হালিম।)
অবশেষে প্যারেন্টসদের তাঁদের সন্তানদের নিকট থেকে বিদায় নেবার পালা। আমাদের প্রত্যেকের হাস্যোজ্জ্বল মুখের ওপর এবার এক অব্যক্ত বেদনার ছাপ পড়লো। চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হলো। জীবনে এই প্রথম তারা তাদের বাবা-মা থেকে দূরে থাকতে যাচ্ছে। প্রত্যেকের বাবা-মা’র আনন্দালোকে উদ্ভাসিত মুখমন্ডলেও যেন সহসাই নেমে এলো কালোমেঘের ছায়া। অমঙ্গল অশ্র লুকোবার প্রচেষ্টা তাঁদের। ঈষৎ প্রকম্পিত কন্ঠে আমার বাবাও আমার নিকট থেকে বিদায় নিলেন। আমি অশ্রু সম্বরণ কোরতে ব্যর্থ হলাম।
ধীর কদমে চলা একটি অশ্বকে অশ্বারোহী হঠাৎ চাবুক মেরে বল্গিত চালে, অর্থাৎ চারটি পা একসঙ্গে তুলে দ্রুততম বেগে চলতে বাধ্য কোরলে অশ্বের যে অবস্থা হয়, ক্যাডেট কলেজে আমার প্রারম্ভিক দিনগুলো আমার জন্য, এবং হয়তো আমাদের ইনটেকের সকলের জন্যই, তেমনই ছিল। সামরিক রীতিতে খুব ভোরে রিভ্যালির সঙ্গে গাত্রোত্থান, নিজে নিজে মশারি, বালিশ, এবং বিছানায় ব্যবহৃত গায়ে দেবার শীটটি পরিপাটি কোরে ভাঁজ কোরে লকারে যথাস্থানে তুলে রাখা, বেডশীটটি ফের টান টান কোরে পাতা্। অতঃপর ওয়াশরুমের কার্যাদি শেষে সাদা হাফ-শার্ট, শর্টস এবং সাদা ক্যাম্বিসের জুতো পরে সৈনিকদের মতো প্লাটুন ফরমেশনে প্রথমে কলেজ ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে চারপাশে ঘোরানো লম্বা রাস্তা দৌড়িয়ে পরিক্রমা শেষে ঘন্টাখানেকের শারীরিক ব্যায়াম; এবং ব্যায়াম শেষে হাউসে ফিরে গোছলাদি সম্পন্নকরত কলেজ ইউনিফর্ম পরিধান কোরে নির্দিষ্ট সময়ে হাউসের সম্মুখে স্কোয়ড/প্লাটুন ফরমেশনে fall in কোরে হালকা মার্চ কোরে ডাইনিং হলে গমন, ইত্যাদি ছিল দৈনন্দিন কর্মকান্ডের অঙ্গীভূত। বিশাল ও দীর্ঘ ডাইনিং হলের দুই প্রান্তে লম্বা হাই টেবিল, যেখানে সবচে’ সিনিয়র ক্লাসের অর্থাৎ দ্বাদশ শ্রেণির ক্যাডেটদের মধ্য থেকে অধ্যক্ষ ও শিক্ষকগণ কর্তৃক সিলেক্টেড প্রিফেক্টগণ/লিডাররা বসেন; এবং দুই প্রান্তের দুই হাই টেবিলের মাঝখানে দুই row কোরে পাতানো বড় বড় টেবিলে অন্যান্য সব ক্যাডেটদের বসার আয়োজন। প্রতিটি টেবিলে ১০ জন কোরে বসে খাবার ব্যবস্থা; এবং টেবিলসমূহে প্রত্যেক ক্যাডেটের নিজ নিজ স্থান নির্ধারিত। ডাইনিং হলের যে প্রান্তের হাই টেবিলে কলেজ প্রিফেক্ট উপবিষ্ট সে প্রান্ত হতে চেয়ার থেকে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলে রাখা ঘন্টা বাজাতেই ডাইনিং হলে নেমে আসে পিন-পতন নীরবতা। তখন অপর প্রান্তের হাই টেবিলে উপবিষ্ট ডাইনিং হল প্রিফেক্টও দাঁড়িয়ে যান। কলেজ প্রিফেক্ট তাকে লক্ষ্য কোরে বলেন, “ডাইনিং হল প্রিফেক্ট, বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম”। ডাইনিং হল প্রিফেক্ট তখন সকল ক্যাডেটদের লক্ষ্য কোরে বলেন, “জেন্টলমেন ক্যাডেটস, বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। সব ক্যাডেটরা তখন সমস্বরে বলেন, “বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। ব্যস, শুরু হয়ে গেল আধাঘন্টার আহার পর্ব। যতদূর মনে পড়ে, ব্রেকফাস্টের জন্য সময় নির্ধারিত ছিল পাঁচ মিনিট কম, অর্থাৎ পঁচিশ মিনিট। আহারের সময় অতিক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে কলেজ প্রিফেক্ট পুনরায় দাঁড়িয়ে ডাইনিং হল প্রিফেক্টকে বলেন, “ডাইনিং হল প্রিফেক্ট, আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আল-আমীন”। “ডাইনিং হল প্রিফেক্ট তখন সকল ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে বলেন, “জেন্টলমেন ক্যাডেটস, আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আল-আমীন”। সকলকেই তখন আহারের সমাপ্তি টেনে বলতে হয় “আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আল-আমীন”। কারো কারো খাওয়া হয়তো তখনো শেষ হয় নি। তথাপি, তা ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়তে হয়। ফোর্ক, স্পূন, টেবিল নাইফ ব্যবহার কোরে খাওয়া-দাওয়া। তাই ওয়াশ-রুমে হাত ধোয়ার কোনো ঝামেলা নেই। সকলেই তখন যার যার মতো কোরে ছুটছে একাডেমিক ব্লকে তাদের নিজ নিজ ক্লাস-রুমের দিকে। কেউই বই-খাতা বহন কোরছে না। কারন, সব পড়ালেখার কাজই কোরতে হতো ক্লাস-রুমে। ক্লাস শেষে হাউসে কোনো বই-খাতা নিয়ে যাওয়ার বা পড়াশোনার কোনো সময় ও সুযোগ দেয়া হতো না।
ক্যাডেটদের লাইফ সামরিক বাহিনীর মতো রেজিমেন্টেড। সংগঠিত ও কঠোর শৃঙ্খলায় বাঁধা। নিজের খেয়ালখুশিমতো কিছুই করা যায় না। ক্লাস চলতো সকাল সাতটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত। প্রতিটি পিরিয়ড ৪০ মিনিটের। ক্লাসে প্রত্যেকের জন্য এক একটি ডেস্ক। প্রত্যেকের জন্য বসার জায়গা নির্ধারিত। ক্লাস শেষে সকলেই নিজ নিজ পড়ার ডেস্কের ওপর থেকে বই-খাতা তুলে ডেস্কের ভেতরে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতো। অতিরিক্ত জায়গা হিসেবে ক্লাসের পিছনের দেয়ালে প্রত্যেকের জন্য ছিল এক একটি কাঠের ছোট লকার। বই-খাতাপত্র, স্টেশনারি, ইত্যাদি সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার পর সবাই আমরা ছুটতাম ডাইনিং হলের দিকে লাঞ্চ কোরবার জন্য।
(চলবে…………)
লেখকঃ মুহম্মদ আজিজুল হক. (চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত)