শাহরিয়ার কবির, নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বর্তমান দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লক্ষাধিক সাংবাদিক।এই মহান একটি পেশায় আসতে লাগেনা বড় কোন ডিগ্রি,কোনো মতেই ফেসবুক চালাতে পারলে হয়ে জান নাম করা সাংবাদিক। আর যদি থাকে মামা,খালু তাহলে আর কথাই নেই,পেয়ে জান দেশের প্রথম সারির পত্রিকা।তার পরে শুরু হয়ে যায় তার সাংবাদিকতা জীবন হয়ে উঠেন বড় মাপের চাঁদাবাজ। অনলাইন পোর্টাল খুলে চলছে রমরমা কার্ড বানিজ্য ব্যবসা। হাজার দেড় হাজার টাকা দিলে মিলছে অনলাইন পোর্টালের সাংবাদিকতার কার্ড অন্যদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রথম সারি, দ্বিতীয় সারি ও আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকায় মিলছে জেলা,উপজেলা,পৌরসভা,কলেজ ক্যাম্পাস প্রতিনিধি।বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা।
(সাংবাদিকতার আড়ালে অপকর্ম)
অন্যদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশা ও ধরে রেখেছে আবার তাঁরা প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের বড় বড় পদে রয়েছেন। কারণ তাঁরা তাদের অপকর্ম ধামাচাপা দিতে চান অন্যদিকে সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন।এমন ঘটনা প্রায় গেল পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়। আবার এমনও আছে বড় বড় ব্যবসা যেমন,বেসরকারি ক্লিনিক,ঠিকাদার, গার্মেন্টস,কল কারখানা সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে বসে আছে,সে সমস্ত ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য টাকা দিয়ে বানিয়ে রেখেছে পত্রিকার কার্ড অন্যদিকে হয়েছেন সম্পাদক।
(শিক্ষাগত যোগ্যতা)
সাংবাদিকতা ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রি পাস এমনটি বহুবার শোনা গেলেও নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। মাধ্যমিকের গণ্ডিনা পেরিলেও টাকা আর মামা,খালুর জোরে হয়ে যাচ্ছে প্রথম,দ্বিতীয় সারির বড় মাপের সাংবাদিক। লিখতে পারেন না কোন প্রতিবেদন অন্যের করা প্রতিবেদন কপি পেস্ট করে চালিয়ে দেন যে যার পত্রিকায়।এমনকি অনেকেই জানেন না সাংবাদিকের ইংরেজি শব্দ কি। আবার অনেকেই সাংবাদিকের ইংরেজি শব্দ বলতে গেলে দাঁত ভেঙে যায়। নিজের পত্রিকায় নাম ইংরেজি বলতে বললে দাঁত ভেঙে যায় এরা আবার বড় মাপের সাংবাদিক।
(অপসাংবাদিকতার কি!)
পৃথিবীর সব পেশায় মহান। তারপরেও মহৎ ও সেবামূলক পেশা হিসাবে সমাজে বেশি প্রচলিত রয়েছে সাংবাদিকদের নাম। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের সম্মান নিয়ে পেশাটি এখনো সগৌরবে রয়েছে। কিন্তু এই সেবামূলক পেশাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে একটি ধূর্তবাজ গোষ্ঠি। সাংবাদিকদের মধ্যে পেশাদারিত্বের এখন বড় অভাব। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সাংবাদিকদের সাথে বর্তমান সময়ের সাংবাদিকদের তফাৎ অনেক। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সাংবাদিকদের যে পেশাদারিত্ব ছিল তা এ যুগের সাংবাদিকদের মধ্যে এখন নেই বললেই চলে।পেশাদারিত্বের কথা মুখে বললেও অন্তরে পোষণ করছে ভিন্নতা। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে চলছে এই পেশাটি। দিন যত যাচ্ছে ততই সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতা বেড়েই চলেছে। একটু চোখ-কান সজাগ রাখলেই দেখা যায় সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতার কি ভয়াবহতা।
অপসাংবাদিকতা রোধে সরকার বারবার উদ্যোগ নিয়েও অদৃশ্য কারণে মাঝ পথে থেমে যাচ্ছে। অপসাংবাদিকতা রোধে সারা দেশের সব সাংবাদিকদেরকে অনলাইন ডেটাবেসে যুক্ত করতে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল যে নীতিমালা চুড়ান্ত করেছে সেটার বাস্তবায়ন কবে হবে সেটাও অজানা।ডিজিটাল আইনের চেয়েও এখন পেশাটির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে অপসাংবাদিকতা। মফস্বলে এখন সাংবাদিকদের নানা নামে ডাকা হয়। কেউ ডাকেন সামবাদিক সাহেব, কেউ বা হলুদ আবার কেউ ডাকে ভূয়া অথবা সাংঘাতিক বলে।
সাংবাদিকের মতো এতো পবিত্রতম একটি শব্দ ও পেশাকে কেন সামবাদিক, হলুদ বা ভূয়া সামবাদিক বলে ডাকা হয় তা কি কখনো গণমাধ্যম বিশিষ্টজনরা ভেবে দেখেছেন? সাংবাদিক শব্দটা যাদের জন্য “সামবাদিক” হয়েছে তাদের লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে। সাংবাদিকতার মতো পবিত্রতম পেশাটাকে এরা কলংকিত করে রীতিমতো উলঙ্গ করে ফেলছে।
ফেসবুকে পোস্ট করেই এরা বলে টিভি নিউজ। সারা জীবন দেখে আসলাম আগামি কালের পত্রিকা ছাপা হয় রাত ১২ টার পরে। অথচ এখন দেখি যখনকার ঘটনা তার কিছুক্ষণ পরই পত্রিকাতে প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। এ আবার কি ধরণের সামবাদিকতা ! পরের দিনের সংবাদ আগের দিনেই প্রকাশ। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়-ওটা পত্রিকা না। পত্রিকার মতো পোস্টার করে ওরা। তারপর ছেড়ে দেয় ফেসবুকে।
আর যাদের নিউজ থাকে তাদের ট্যাগ করে দেওয়া হয়। এতে নাকি ঐ সাংবাদিকের গুরুত্ব বাড়ে। যত তাড়াতাড়ি নিউজ এনে দিতে পারবে তত বড় সামবাদিক হতে পারবে তারা। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে এরা দিনের পর দিন এভাবেই সেবামূলক মহান পেশাটাকে উলঙ্গ করছে সব জায়াগাতে।
১৫০০ টাকা দিয়ে অনলাইন খুলেই সম্পাদক, স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র রিপোর্টার, জেলা প্রতিনিধি হয়ে যাচ্ছে। যোগ্যতার কথা নাই বা তুললাম। কোন রকম ফেসবুকে শেয়ার করার মতো যোগ্যতা থাকলেই হলো। প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা এখানে চতুর্থ বিষয়। প্রযোয্য নহে।
যখন দেখি দেশের প্রথম সারির পত্রিকা তাদের জেলা প্রতিনিধি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শর্ত দেন শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে স্নাতক। তখন স্বপ্ন দেখি সাংবাদিকতার সুদিনের। কিন্তু যখন দেখি স্নাতক তো দূরের কথা কোনদিন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পা দেয়নি এমন লোককে তাদের প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ দেন তখন চরম হতাশায় নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয়। যাদের আয়ের কোন উৎস নেই অথচ তারা দিব্যি বাড়িতে বিল্ডিং, ল্যাপটপ, মোটরসাইকেলসহ দামি ব্রান্ডের মোবাইল ব্যবহার করছেন। কোথায় পাচ্ছে এগুলো? দিচ্ছে বা কে! জাতির কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম।
যখন দেখি দেশের প্রথম সারির মিডিয়ার সহকর্মীরা ঐ সকল ভূঁইফোড় অনলাইন, আন্ডারগ্রাউন্ডের পত্রিকা ও টিভির নামে ফেসবুকে দেওয়া সামবাদিকদের হাতে হাত ধরে কোন দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় দাঁড়ায় তখন নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। এই মহান পেশার বন্ধুরা কি এতোটাই মানষিক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে। এভাবে হাতে হাত ধরে দাবি আদায়ে রাস্তায় দাঁড়ালে সব সময়ই অধিকার আদায় হয় কিনা জানিনা। তবে হলফ করে এটুকু বলতে পারি- আপনাদের সাথে হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছবি তুলে ঐ সকল সামবাদিকরা লাভবান হয় সব জায়গায়। তারা ঐ ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে সবাইকে জানান দেয় তারা এখন বড় মাপের সাংবাদিক।
এ সকল সাংবাদিকদের মানবিক, জনদুর্ভোগ কিংবা উন্নয়নমূলক কোন প্রতিবেদন তৈরি করতে দেখা যায় না। কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা হত্যাকান্ড ঘটলে ঘটনাস্থলেও তাদের চোখে পড়েনা। কারণ এ সকল সংবাদ সংগ্রহে কোন অর্থ পাওয়া যায় না। বরং আরো নিজের পকেট থেকে যায়। এদের বেশি দেখা যায় সংবাদ সম্মেলনের স্থানে, গ্রামের আনাচে-কানাচে। গ্রামের সরল-সহজ মানুষগুলোকে রীতিমতো সাংবাদিকতার ভয় দেখিয়ে এরা হাতিয়ে নেয় অর্থ। সংবাদ সম্মেলনের গিয়ে এদের জন্য ছবি তোলায় দায় হয়ে পড়ে মূলধারার সাংবাদিকদের।
এখনো সময় আছে। যারা গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করছেন যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদেরকে এ সকল ভূয়া ও হলুদ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এদের লাগাম টেনে ধরার। এখনই সবার উচিত এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে দেশের গণমাধ্যমকে আরো অধিক স্বচ্ছতার জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। আর এ কাজে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল সহযোদ্ধাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই হয়ত দেশের গণমাধ্যম পেশাদারিত্বের সফলতার জায়গায় পৌঁছে যাবে।
প্রিয় পাঠক এবং সহকর্মীবৃন্দ, দুঃখিত পবিত্রতম সাংবাদিক শব্দটাকে বিকৃত করে সামবাদিক লেখার জন্য। অনেকটা নিরূপায় ও হতাশ হয়েই শব্দটা ব্যবহার করলাম। সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এখনো স্বপ্ন দেখি নতুন ভোরের। এই মহান পেশায় এখনো রয়েছে অনেক নিবেদিত সহকর্মী। যাদের হাত ধরে সাংবাদিকতা পেশাটা সত্যি সেবামূলক পেশায় পরিণত হবে। পরিশেষে একটি সুন্দর দিন ও নতুন সূর্যের অপেক্ষায় থাকলাম। নিপাত যাক অপসাংবাদিকতা; জয় হোক বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার।