এসএম শহীদুল ইসলাম,সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরায় এবার আমের ফলন ভালো হওয়ায় এবং ঝড়বৃষ্টির কবলে না পড়ায় অধিক ফলনের আশা করছেন বাগান মালিক ও চাষিরা। আশানুরূপ ফলন হলে ২২৫ কোটি টাকার আম বিক্রি হবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
আম চাষি, ব্যবসায়ী ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বছর জেলার চার হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। বড় কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে দেশের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রপ্তানি করা যাবে সাতক্ষীরার আম। এতে আয় হবে ২২৫ কোটি টাকার বেশি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে আমের ফলন কম হয়েছিল। এবার প্রতি গাছে যেভাবে আম ঝুলছে, তা দেখে খুশি চাষিরা। বাম্পার ফলনের আশা করছেন তারা।
কৃষি বিভাগ জানায়, মাটি, বাতাস ও আবহাওয়া ভালো হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে জেলায় হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি, মল্লিকা, গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ, বোম্বাইলতা ও গোপালখাসসহ অন্যান্য জাতের প্রচুর আম উৎপাদন হয়। চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। এ বছর নবমবারের মতো ইংল্যান্ড ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে যাবে এই জেলার আম।
আবহাওয়া এবং পরিবেশগত কারণে অন্য জেলার চেয়ে সাতক্ষীরায় আম আগে পাকে। এ জন্য দেশের বাজারে সবার আগে এখানকার আম বিক্রি শুরু হয়। গত কয়েক বছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চাষিরা। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হয়েছে। তবে প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে কিছু গুটি ঝরে পড়ছে। এতে উৎপাদনে প্রভাব পড়বে না দাবি কৃষি বিভাগের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর সদর উপজেলায় এক হাজার ২৩৫ হেক্টর, কলারোয়ায় ৬৫৫ হেক্টর, তালায় ৭১৫ হেক্টর, দেবহাটায় ৩৭০ হেক্টর, কালিগঞ্জে ৮৩৫ হেক্টর, আশাশুনিতে ১৪৫ হেক্টর ও শ্যামনগরের ১৬০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। সবমিলে চার হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। জেলায় সরকারি তালিকাভুক্ত পাঁচ হাজার ২৯৯টি আমবাগান ও ১৩ হাজার ১০০ চাষি রয়েছেন। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। যে ফলন হয়েছে, তাতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
পৌরসভার মুনজিতপুর এলাকার মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ জেলার আম অতুলনীয়। হিমসাগর বিখ্যাত। ল্যাংড়া ও আম্রপালির চাহিদা বেশি। গত বছর ১৫টি বাগান কিনেছিলাম। এ বছর ২০টি বাগান লিজ নিয়েছি। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে আছে। আম দ্রুত বড় হচ্ছে। গত কয়েক বছর দুর্যোগের কারণে মূলধন হারিয়ে ফেলেছিলাম। এবার বাম্পার ফলন হয়েছে, আশা করছি লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবো।’
পৌরসভার রাজারবাগান এলাকার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর উৎপাদন কম হওয়ায় লোকসান হয়েছিল। এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। বাগান লিজ নিলে তার পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়। বাগান পরিচর্যা, পোকামাকড় মুক্ত করতে ওষুধ প্রয়োগ, ফলনের পর বাজারজাত, শ্রমিকের পেছনে অনেক টাকা ব্যয় হয়। ফলন ভালো হলে আমাদের লাভ হয়। এবার আশা করছি, লাভের মুখ দেখবো।’
এবার আমের ফলন ভালো হয়েছে বলে জানালেন সুলতানপুর বাজারের আড়তদার মতিয়ার রহমান। তিনি বলেন, ‘এ বছর কাঁচা আমের মণ ১৪০০-১৫০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা গ্রামের চাষিদের কাছ থেকে কম দামে কাঁচা আম কিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদেরও লাভ হচ্ছে।’
গত বছর পাকা আমের কেজি ৫০ টাকা বিক্রি হয়েছিল উল্লেখ করে মতিয়ার রহমান বলেন, ‘এবার আরও বেশি দামে বিক্রি হবে। আমের সাইজ বড় ও দেখতে সুন্দর হলে ৮০ টাকা পর্যন্ত কেজি বিক্রি হয়। বিগত বছরগুলোতে দেড়শ’ থেকে দুইশ’ কোটি টাকার আম বিক্রি হয়েছে। এ বছর আরও বেশি হবে।’
একই কথা জানালেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রতিটি গাছে প্রচুর মুকুল এসেছিল। সেই পরিমাণ গুটি ধরেছে। গুটি থেকে আমের আকার বড় হয়েছে। তুলনামূলক কম ঝরেছে। এজন্য বেশি উৎপাদনের আশা করছি।’
এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন উল্লেখ করে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ফলন ভালো হয়েছে। উৎপাদনে রেকর্ডের আশা করছি। গড়ে ৫০ টাকা কেজি ধরলে ২২৫ কোটি টাকার আম বিক্রি হবে।’
এবার বিষমুক্ত ও নিরাপদ আম উৎপাদন এবং রপ্তানির জন্য চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে এই কৃষিবিদ বলেন, ‘সবকিছু ঠিক থাকলে এবার ইতালি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি ও ইংল্যান্ডের শপগুলোতে যাবে সাতক্ষীরার আম।’
এদিকে, আম নিরাপদ প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ ও বাজারজাত করার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। সূচি অনুযায়ী, আগামী ১২ মে থেকে গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ, বোম্বাই ও গোপালখাসসহ অন্যান্য স্থানীয় আম পাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চাষিদের। ২৫ মে থেকে হিমসাগর, ১ জুন ল্যাংড়া ও ১৫ জুন থেকে আম্রপালি পাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে আম পাড়লে অপরিপক্ব থেকে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।