মহানন্দ অধিকারী মিন্টু; ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। এ দিন খুলনার পাইকগাছায় কপিলমুনি পাক হায়েনা ও তাদের দোসরদের কবল থেকে মুক্ত হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তথা ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কপিলমুনির ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। কপিলমুনি ছিল রাজাকারদের দুর্গ এবং শক্তিশালী ঘাঁটি। এ ঘাঁটির মাধ্যমে কপিলমুনি, তালা, ডুমুরিয়াসহ খুলনা ও সাতক্ষীরার বিশাল অংশ রাজাকাররা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। খুলনার ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যিক নগরী বিনোদগঞ্জ প্রতিষ্ঠাতা রায় সাহেব বিনোদ বিহারীর বাড়িটি ছিল রাজাকারদের ঘাঁটি। সাড়ে তিনশ’র বেশি রাজাকার ও মিলিশিয়ার ছিল সশস্ত্র অবস্থান। সুবিশাল দোতলা ভবন, চারদিকে উঁচু প্রাচীর অনেকটা মোগল আমলের দুর্গের মতো। সুরক্ষিত দুর্গে বসে চলতো তাদের অত্যাচার। ১৯৭১ সালের এই দিনে দ্বিতীয় দফার দীর্ঘ ৪৮ ঘণ্টার সম্মুখযুদ্ধের পর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পতন ঘটেছিল খুলনার দক্ষিণে সবচেয়ে বড় রাজাকার ঘাঁটিটির। আত্মসমর্পণ করা ১৫৫ জন রাজাকারকে জনতার রায়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। যুদ্ধকালীন জনতার রায়ে এতো সংখ্যক রাজাকারদের একসঙ্গে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ঘটনা সম্ভবত আর নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনামতে, তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দোসররা দেশব্যাপী সাধারণ নীরিহ মানুষের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার নির্যাতন চালাতে থাকে। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুক্তিকামী মানুষের সহযোগীতায় প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় পাক দোসররা ব্যাপক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিনোদ বাবুর সুরম্য বাড়িটি রাজাকাররা দখল নেয়। প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে ভোর ছয়টা নাগাদ কারফিউ জারি করা হতো এলাকায়। সুরক্ষিত দুর্গে বসে চলতো তাদের অত্যাচার। এলাকাটিতে হিন্দুদের বসবাস বেশি থাকায় তাদের ওপর চলতো অমানবিক নির্যাতন, ধন-সম্পদ লুট এমনকি জোর করে তাদের অনেককেই ধর্মান্তরিত করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। হত্যা করা হয় শত শত মানুষকে। লালসার শিকার হন অগণিত মা-বোন। তাঁদের নির্যাতনের মাত্রা এতটা ভয়াবহ ছিল যে, আজও সে দিনের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকেই গা শিহরে ওঠেন। মানুষ ধরে দেয়ালে পেঁরেক দিয়ে শরীর গেঁথে রাখা হতো। হাত-পা কেটে ছিটানো হতো লবণ। এমনকি বড় বড় ইট দিয়ে শরীরে আঘাত করে হত্যা করা হতো। নির্যাতন করে হত্যার পর গোপণ সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে লাশ পাশের বহমান কপোতাক্ষ নদে ফেলে দেয়া হতো এক পর্যায়ে তাদের অত্যাচারে এলাকার মানুষের জান-প্রাণ হয়ে ওঠে ওষ্ঠাগত। পাক হায়েনা ও তাদের দোসরদের অত্যাচারে উপজেলার রাড়–লী, বাঁকা, বোয়ালিয়া ও গড়ইখালী মুক্তিফৌজের ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। খুলনাঞ্চলের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। সাড়ে তিনশ’র বেশি পাক সেনা ও তাদের দোসরের অবস্থান ছিল এখানে। ঘাঁটির ছাদের ওপর সব সময় তাক করে রাখা হতো ভারি কামান ও মেশিনগান। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর খুলনাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা মিলিত হন তালা উপজেলার মাগুরার জনৈক শান্তির দোতলা বাড়িতে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় কপিলমুনি দুর্গে আঘাত হানার। প্রথমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ৬ ডিসেম্বর রাতে কপিলমুনি ক্যাম্প আক্রমণ করা হবে। কিন্তু ৬ ডিসেম্বর স্থানীয় হাটের দিন থাকায় লোকজনের সঙ্গে পথে দেখা হতে পারে ও শত্রæ ঘাঁটিতে খবর পৌঁছে গেলে পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে আশঙ্কায় তা পিছিয়ে দেওয়া হয়। পরে উপজেলার রাড়–লী ও হাতিয়ারডাঙ্গা ক্যাম্প কমান্ডাররা সমন্বিত যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। নৌ কমান্ডার গাজী রহমত উল্লা দাদু, স ম বাবর আলী, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, গাজী রফিক, ইউনুস আলী ইনু, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবর, শেখ শাহাদাৎ হোসেন বাচ্চু, মোড়ল আব্দুস সালাম, আবুল কালাম আজাদের যৌথ নেতৃত্বে অবশেষে ৭ ডিসেম্বর মধ্যরাতে চারিদিক থেকে কপিলমুনি শত্রæঘাঁটি আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। পরদিন ৭ ডিসেম্বর কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা নিজ নিজ ঘাঁটি থেকে একযোগে রওনা হন। ৭ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে ৯ ডিসেম্বর সকাল ১১টা পর্যন্ত চলে। কামান-মেশিনগানের বিকট শব্দে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আচমকা ঘুম ভেঙে যায় মানুষের। দীর্ঘ লড়াই শেষে ৯ ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে ১৫৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আত্মসমর্পণকারী রাজাকারদের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তা নিয়ে ইউনুচ আলী ইনু, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান, সাইদুর রহমান টুকু, গাজী রহমাতুল্লাহ দাদু প্রমুখ বৈঠকে বসেন। এরপর সেখান থেকে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চারজন পালিয়ে যায়। যুদ্ধে শহিদ হন দুইজন মুক্তিযোদ্ধা খুলনার বেলফুলিয়ার আনোয়ার হোসেন ও সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙ্গা গ্রামের আনছার আলী গাজী। আহত হন মোহাম্মদ আলী ও তোরাব আলী সানাসহ অনেকে। মুক্তিযোদ্ধারা আটক রাজাকারদের বন্দি করে নিয়ে যান ঘাঁটির সামনের কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে। রাজাকার ঘাঁটিতে দেয়ালে পেঁরেকবিদ্ধ তালার মাছিয়াড়া গ্রামের রহিম বক্স গাজীর ছেলে সৈয়দ আলী গাজীর ঝুঁলন্ত লাশ দেখে আঁতকে ওঠেন। এ খবর মুহুর্তে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে এলাকার হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে সেখানে। উপস্থিত জনতার দাবির প্রেক্ষিতে আটক রাজাকারদের প্রকাশ্যে গুলি করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। তবে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে অবহেলিত কপিলমুনি গৌরবগাঁথা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ইতিহাস। ভুলতে বসেছে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম কপিলমুনি যুদ্ধের ইতিহাস। আজও সেভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়ীত স্থাপনা ও স্থানগুলো। তবে ২০২০ সালে ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজের উদ্বোধন ও মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিস্থানগুলো পরিদর্শন করেন সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় মন্ত্রী আ.ক.ম মোজ্জামেল হক (এমপি)। এসময় উপস্থিত ছিলেন, সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবু. জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয় সচিব শেখ ইউসুফ হারুন. মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব তপন কান্তি ঘোষ এবং উপজেলা মুক্তিযোদ্ধারা প্রমূখ। আজও স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। অথচ ভ‚মিদস্যুরা ঐ স্থানে বাণিজ্যিকসহ আবাসিক প্রতিষ্ঠন গড়ে তুলেছে। ধ্বংস করছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন ইতিহাস। গৌরবগাঁথা কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আজও সংরক্ষণ করা হয়নি।