মহানন্দ অধিকারী মিন্টু: মরোণত্তর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রাপ্ত বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর স্মৃতি আজও অ-রক্ষিত। একে-একে পেরিয়ে গেল গুরুদাসী মৃত্যুর ১৫টি বছর। অবশেষে বর্তমান সরকার গত ২০২০ সালে ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক গেজেটে গুরুদাসী মাসীকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে। কিন্তু আজও সংরক্ষণ করা হয়নি তার স্মৃতি ও শেষ আবাস স্থল টুকো। স্বাধীনতা পরবর্তী রোগ-শোকে আর অযতেœ-অবহেলায় বীরাঙ্গনা গুরুদাসীর কি হবে। মুক্তিযুদ্ধে রাজাকাররা তার সর্বস্ব লুটে স্বামী-সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৫ বছর আগে ৮ ডিসেম্বর হৃদয়ে নির্মম যন্ত্রনা নিয়ে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তার শেষ আশ্রায়স্থল আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। তালাবদ্ধ তার বসত ঘরে আশ্রয়স্থল হয়েছে কীটপতঙ্গের। রাতে আশেপাশে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ আর নেশাখোরদের আর্ড্ডা। অথচ তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে গঠন করা হয়েছিল বীরাঙ্গনা গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ। আর তার বসবাসের বাড়িটি স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার তৈরির ঘোষণা দেয়া হয় ওই সময়। একপ্রকার নিরবে নিভৃতে একে-একে পেরিয়ে গেল ১৫টি বছর! কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী রোগ-শোকে আর অযতেœ-অবহেলায় মৃত বীরাঙ্গ গুরুদাসীর কি হবে? গুরুদাসী কি পাবে না মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি! অবশেষে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিললো, মরণোত্তর! ১৯৭১ সাল। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটিয়া ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামের গুরুপদ মন্ডল পেশায় দর্জি হলেও সবার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। স্বাধীনতাকামী অত্যন্ত সহজ-সরল বিনয়ী একজন মানুষ। ২ ছেলে ২ মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাধ্যমতো সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তিনি। রাজাকারদের ইন্ধনে পাক বাহিনী তার বাড়িতে হামলা চালায়। একে-একে পরিবারের সব সদস্যকে বাড়ির উঠানে জড়ো করা হয়। তার স্ত্রী গুরুদাসী মন্ডলের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে পাক সেনাদের। নিজ স্ত্রীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে এগিয়ে এলে গুরুদাসীর সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় তার স্বামী, ছেলে অংশুপতি, খোকন ও মেয়ে অঞ্জলিকে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃতদেহ বীভৎস করে দেয়া হয়। এরপর গুরুদাসীর দুধের শিশু পারুলকে মাতৃক্রোড় থেকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। মায়ের সামনেই তাকে পুঁতে ফেলা হয় বাড়ির পাঁশে কাদা পানির ভেতরে। তারপর গুরুদাসীর ওপর হায়েনারা পাশবিক নির্যাতন শুরু করে। পাক হানাদাররা চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী গুরুদাসীকে উদ্ধার করে। নিজ চোখের সামনে স্বামী, ছেলেমেয়ের মৃত্যু এবং পাক সেনাদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়ে গুরুদাসী ততক্ষণে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা গুরুদাসীকে উদ্ধার করে তাদের হেফাজাতে রাখেন। দেশ স্বাধীনের পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় উদবাস্তের মতো ঘুরে এক সময় ফিরে আসেন স্বামী-সন্তানের স্মৃতি বিজড়িত খুলনার পাইকগাছায়। মানসিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসী ভিক্ষা করে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যান। হাতে ছোট্ট লাঠি, মানুষকে হাসতে হাসতে ভয় দেখানো আর হাত পেতে ২ টাকা চেয়ে নেয়া-এভাবেই গুরুদাসীর দিন কাটতে থাকে। গুরুদাসী হয়ে ওঠেন এলাকার সবার কাছের মানুষ, পরিচিত মুখ। পরে বাগেরহাট জেলা পরিষদের প্রসাশক মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু, পাইকগাছা উপজেলার চেয়ারম্যান স ম বাবর আলী ও ততকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা মিহিরকান্তি মজুমদার কপিলমুনিতে সরকারি জায়গায় গুরুদাসীর বসবাসের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করে দেন। সেখানেই অনাদরে, অযতেœ, অভাবে দীর্ঘদিন পড়ে থাকেন তিনি। ২০০৮ সালের ৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে কোনো এক সময় মৃত্যু বরণ করেন তিনি। প্রভাতে নিজের শয়নকক্ষে তার মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখে পার্শ্ববর্তী লোকজন। গুরুদাসীর মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে আসেন মুক্তিযোদ্ধা, প্রশাসনসহ সর্বস্তরের মানুষ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুদাসীর আত্মত্যাগের কথা আজও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। এক রকম সবাই ভুলে গেছে গুরুদাসীকে। স্থানীয়দের দাবি মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রাপ্ত গুরুদাসী মাসীর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী সরকারীভাবে পালনে। এবং তার শেষ স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হোক। না-হলে আগামী প্রজ¤œ ভুলে যাবে দেশের স্বার্থে গুরুদাসীর ত্যাগের কথা! খুলনা অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল কাইয়ুম ২০১৪ (২০১৬ সালে চলে গিয়েছেন সবাইকে ছেড়ে) সালে স্মৃতিচারণে বলেন, বারোআড়িয়ায় রাজাকার ক্যাম্প দখলের পর আমরা সবাই নৌকায় উঠছি। গুরুদাসী মন্ডল কাঁদতে কাঁদতে আমাদের নৌকায় এসে উঠলেন। জীবনের এই দুরবস্থা দেখে ফেলতে পারিনি। তখনো তার দারুণ যৌবন, খুব সুন্দর মানুষটি। একাত্তরের অন্যতম নায়িকাকে যেন কোনো মানুষ স্বাধীন দেশে অপমান না করেন সে জন্য আমরা তাকে ‘মা’ বলে ডাকতাম। সম্মান দিতাম। পরে সেটিই ছড়াল। সন্তান হারানোর ব্যথায় সবাইকে সন্তানের মতো দেখতেন তিনি। তার মৃত্যুর পরবর্তী বছরে একবারও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা স্মরণসভা করতে পারেনি। কপিলমুনি আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির সভাপতি সরদার ফারুক আহম্মেদ গুরুদাসী মাসীর স্মরণসভা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে না জানিয়ে বলেন, সরকারীভাবে পালন করা হোক। মুক্তিযোদ্ধা বাবর আলীর আক্ষেপ, “মা গুরুদাসীর বসতঘরটিতে নেশাসক্তদের আড্ডাস্থল হয়ে গিয়েছে। ‘গুরুদাসী মন্ডল স্মৃতিরক্ষা’ নামের সাইনবোর্ড ঝোলানো হলেও সেটির এখন আর চিহ্নও নেই। খুলে নিয়েছে। বাড়ির আঙিনা, ভেতরে, আশপাশে মলমূত্র ত্যাগ হয়। তার জন্য যে পাকা ঘর বানিয়ে দিয়েছিলাম আমরা সবাই মিলে, এখন সেটি বেদখলে। ২০০৮ সালেই তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে ‘গুরুদাসী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ’ গড়ে তুলেছি আমরা। তাদের খুব কার্যক্রম চোখে পড়ে না। সেদিনই বাসাটিকে গুরুদাসী মন্ডল স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা হয়েছিল।