রামপ্রসাদ কর্মকার, পাইকগাছাঃ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জনপদ খুলনার পাইকগাছায় কপিলমুনিতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে সাজ সাজ রব। দুর্গাপূজা মূলত সনাতনীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও জনপদে সেই স্মরণাতীতকাল থেকে সার্বজীনন বাঙালির উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। পূজার পাশাপাশি মূর্তির সৌন্দর্য বর্ধন, মন্ডপ সাজস্বজ্জা, আলোকস্বজ্জা ও গেট তৈরিতেও স্ব-স্ব কর্তৃপক্ষ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার সর্বাতœক চেষ্টা করছেন। পূজারী দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট ও মন কাঁড়তে পূজার পাশাপাশি বাড়তি আয়োজন করা হয় ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি-বর্গ, স্থান বা ইতিহাস-ঐতিহ্যকেও প্রাধান্য দেওয়া হয় পূজার পাশাপাশি বাড়তি আয়োজনে। এতে দর্শনার্থী পূজারীদের কাছে মূল পূজার পাশাপাশি উঠে আসে স্ব-স্ব এলাকার ঐতিহ্য ও বিশিষ্টজনদের জীবনী ও তাদের কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে। এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। দেবদেবীর মূর্তি ও মন্ডপের সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি বিখ্যাত মন্দিরের আদলে গেট বা প্যান্ডেল করা হয়েছে। তবে এবার পূজায় উপজেলার কপিলমুনি মিলন মন্দির কেন্দ্রীয় পূজা মন্ডপ কর্তৃপক্ষ মূল পূজার পাশাপাশি দর্শনার্থীদের দৃষ্টি কাড়তে উপস্থাপন করেছে একটি ব্যতিক্রমী বিষয়। যা সনাতনীদের পাশাপাশি ভিন্নধর্মাবলম্বীদের মাঝেও দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। আধুনিক কপিলমুনির রূপকার জনপদের সাধারণ মানুষের অমর প্রাণ পুরুষ স্বর্গীয় রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুকে। ২০ অক্টোবর মহাষষ্ঠী। ২১ অক্টোবর মহা সপ্তমীতে সন্ধ্যায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, গান ও নৃত্যানুষ্ঠান। ২২ অক্টোবর মহা অষ্টমীর সন্ধ্যায় যাদু প্রদর্শনী ও মনোজ্ঞ সঙ্গীতানুষ্ঠান। এতে যাদু প্রদর্শন করবেন, বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান জাদুশিল্পী যাদুজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ‘জাদুসূর্য’ পি.সি.সাহা। ২৩শে অক্টোবর মহানবমীতে সন্ধ্যায় সংগীতানুষ্ঠান ও রাত ৯টায় অনির্বাণ শিল্প গোষ্ঠীর পরিবেশনায় ‘নবরূপে মহা দুর্গা’ তবে এবার পূজায় বিশেষ আকর্ষণ আধুনিক কপিলমুনির স্থপতি স্বর্গীয় রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুকে উপস্থাপন করেছে ভিন্নরূপে। রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু গোটা জীবন পরিক্রমার ভাস্কর্য প্রদর্শন। রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু ১৮৯০ খৃষ্টাব্দের ২০মে কপিলমুনিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম যাদব চন্দ্র সাধু ও মাতার নাম সহচরী দেবী। তিনি ৪ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে ভাইদের সারীতে তৃতীয় ছিলেন। ভাস্কর্যটির মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ তার শৈশবের একটি খন্ড চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যেখানে বাবা-মায়ের সাথে খেলার ছলে দেখা যাবে শিশু বিনোদকে। রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু ছিলেন, জনপদের অন্যতম শিক্ষানুরাগী। জন্মস্থান কপিলমুনি থেকে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে প্রায় ৭কি:মি: দূরে কপোতাক্ষ নদ পেরিয়ে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার আচার্য পিসি রায় প্রতিষ্ঠিত রাড়–লী আর.কে.বি.কে হরিশচন্দ্র ইনস্টিটিউটে অধ্যায়নে যেতেন। তিনি স্যার পিসির রায়ের আশীর্বাদপুষ্ট শিক্ষার্থী ছিলেন। ভাস্কর্যের মাধ্যমে বিনোদের শিক্ষাজীবনের একটি খন্ড চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে স্যার পিসি রায়কে প্রণাম করতে দেখা যাচ্ছে শৈশবের ক্ষুদে শিক্ষার্থী বিনোদকে। শৈশবে স্কুলের পাঠ শেষ না করেই বিনোদ তার বাবার হাত ধরে ব্যবসা জীবনে পদার্পণ করেন। ব্যবসায়ীক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে গিয়ে ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জনে তিনি বিভিন্ন সময় নানা কৌঁশলের আশ্রয় নিতেন। কেরোসিনের ব্যবসায় তৎকালীণ ক্রেতাদের হারিকেন ও কুপি (টেমি বা লম্প) জন্য বিনামূল্যে সলতে বিতরণ করতেন। ব্যবসা জীবনে এমন নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। ভাস্কর্যে বিনোদের ব্যবসা জীবনের চিত্র তুলে ধরতে দু’জন ক্রেতাসহ তাকে দেখা যাবে কেরোসিন বিক্রি করতে। রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু ছিলেন, কপিলেশ্বরী মায়ের আশীর্বাদপুষ্ট। আধুনিক কপিলমুনির রূপকার ছিলেন তিনি। জনপদের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে নিজ নামে প্রতিষ্ঠা করেন বিনোদগঞ্জ। জনশ্রæতি রয়েছে, একবার বারুণী মেলায় আগত শাঁখারি হতে বিনোদের কণ্যা রূপ ধরে বাকিতে শাঁখা পরে বাবা বিনোদের কাছ থেকে টাকা নিতে বলেন। বিনোদকে পেয়ে মেয়ের শাঁখার টাকা চাইতে কিঞ্চিত বিলম্ব করে টাকা পরিশোধ করে চলে যান কপিলেশ্বরী কালী মন্দিরে। সেখানে গিয়ে দেখেন মায়ের হাতে শাঁখা। তখন তার বুঝতে বাকি ছিলনা, শাঁখা নিতে সেই গিয়েছিল শাঁখারির কাছে। ভাস্কর্যে তাই শাঁখারির হাত থেকে কপিলেশ্বরী মায়ের শাঁখা পরা ও পিতা রূপে বিনোদকে তুলে ধরা হয়েছে। এভাবে ক্ষণজন্মা বিনোদ ক্রমান্বয়ে একদিন হয়ে ওঠেন, রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু হিসেবে। নানা কীর্তিগাঁথায় ব্রিটিশ সরকার তাকে রায় সাহেব উপাধিতে ভ‚ষিত করে সম্মাননা প্রদান করেন। মূলত বিনোদ তার জীবদ্দশায় নিজ নামে বিনোদগঞ্জ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মায়ের নামে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির, ব্যবসায়ীক লেনদেন ও ব্যবসায়ীদের সঞ্চয়ী করতে সিদ্ধেশ্বরী ব্যাংক, অর্মতময়ী মিলনায়তন, ভরত চন্দ্র হাসপাতাল, একমাত্র বেদ মন্দির, কপিলেশ্বরী মায়ের মন্দির পূণ:নির্মাণ, সহচরী সরোবর, দক্ষিণাঞ্চলে প্রথম এক্সরে মেশিন, প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি প্রজ্জ্বলন জেনারেটরের মাধ্যমে। ভাস্কর্যে তার কীর্তিগাঁথা অনেক কিছুই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ভাস্কর্যের মাধ্যমে। শারদীয় দুর্গোৎসবে ধারণা করা হচ্ছে, এবার জেলার শ্রেষ্ট প্রতীমার মর্যাদা পাবে। পাইকগাছা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রফিকুল ইসলাম জানান, উপজেলায় ১৫৫টি দুর্গাপূজা মন্দির কমিটির স্বেচ্ছাসেবক টিমের সাথে আনসার, পুলিশ ও সাদা পোশাকে থাকবে প্রশাসনের নিরাপত্তা কর্মীরা। সকলে একত্রে সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করবে। ঝুঁকিপূর্ণ মন্দিরগুলোতে আমাদের সার্বক্ষণিক নজরদারী থাকবে। তবে এবার পূজায় পুলিশ হেডকোয়াটারের ৯৯৯ নাম্বার সেল ফোন কল জোরালো ভ‚মিকা রাখবে। সেখানে বিশেষ করে কোন দুর্গা মন্দির থেকে অপ্রীতিকর ঘটনার আশংকায় ফোন পাওয়ার সাথে সাথে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের সকল প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। স্পেশাল টিমও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।